অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে আইন বিজ্ঞানের সম্পর্ক কি ?
সামাজিক বিজ্ঞান কি তার কোনো সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়া সম্ভব নয় । সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জনে নিয়োজিত বিষয়গুলোকে মোটামুটিভাবে সামাজিক বিজ্ঞান বলা যায় । সমাজ বলতে কতিপয় লোকের বা গোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বুঝায় না । সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি এগিয়ে আসে এবং যারা একটা অভিন্ন ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অধিকারী এরূপ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সমাজ বলা যায় । আর বস্তুনিষ্ঠভাবে অর্থাৎ নিরপেক্ষভাবে তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষিত তত্ত্বের মাধ্যমে অধ্যায়ন করা হচ্ছে বিজ্ঞান । তাই সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ অধ্যায়ন হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান।
একটি সমাজ বেশ জটিল বিষয়। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সৃষ্টি হয়েছে। তাই সমাজতত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও আইন বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ কি করে এবং কেন করে এর জবাব খুজে সমাজবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান। কিন্তু মানুষ তার নিজের খেয়াল-খুশি মতো আচরণ করতে পারে না, তাহলে অন্যের অসুবিধা হতে পারে । আবার অন্যের অসুবিধা হতে পারে এ আশঙ্কায় তার আচরণ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না । তাই পারস্পরিক সংঘাতকে পরিহার করার উদ্দেশ্যে যুক্তিসম্মত মাত্রায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। আইন এরূপ নিয়ন্ত্রণের একটি পন্থা । সমাজে বাস করতে হলে মানুষকে কি করতে হবে তার নির্দেশ দেয়ায় আইন।
বিভিন্ন বিজ্ঞানি তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আইন বিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। স্যামন্ড (Salmond) আইন বিজ্ঞানের সজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছে যে, দেশের আইনের প্রাথমিক মূল নীতিগুলির বিজ্ঞান হচ্ছে আইন বিজ্ঞান। রোমান আইন শাস্ত্রবিদ আলপিয়ানের মতে, মানবিক ও ঐশ্বরিক বিষয়বস্তুর পর্যবেক্ষণ এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিজ্ঞান হচ্ছে আইন বিজ্ঞান। ব্রিটিশ আইন বিজ্ঞানের জনক নামে পরিচিত স্যার জন অস্টিন,- আইন বিজ্ঞান কে মানুষ্য কর্তৃক নির্ধারিত আইনের দর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অপর একজন রোমান আইনবিশারদ সিসারো, আইন বিজ্ঞানকে দর্শন শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। তার মতে, দর্শন শাস্ত্রের নিরিখেই আইনকে অধ্যায়ন করতে হবে। বেনথাম বলেন যে, প্রচলিত আইনের বিস্তৃত আলোচনা ও আদর্শ আইনভিত্তিক সম্পর্কিত ধ্যানধারনাই হচ্ছে আইন বিজ্ঞান। প্রখ্যাত আইন বিজ্ঞানী জুরিস্ট প্যাটন আইন বিজ্ঞান কে চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত আইন শাস্ত্র বা সমতার নীতি সম্পর্কিত আইন শাস্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেন অধ্যাপক হল্যান্ডে তার মতে, যথার্থ আইন এর আনুষ্ঠানিক বিধান হচ্ছে আইন বিজ্ঞান। আইনের শাসন দ্বারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এর বিধি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান।
সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধের উপর নির্ভরশীল আইনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আইন বিজ্ঞান কে সঠিকভাবে বুঝতে হবে । আইন বিজ্ঞান শুধু আইন জানতে সাহায্য করে না, আইন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার, গবেষণা করার এবং প্রয়োগ সম্পর্কে শিখতে সাহায্য করে। ক্রমবরধমান আইনবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে মূলতঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত :
প্রথমতঃ প্রখ্যাত আইন বিজ্ঞানী প্যাটন, এর মতানুসারে আইন বিজ্ঞান এর কাজ হচ্ছে আইনের প্রকৃতি, আইনগত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রকৃতি, এগুলোর বিকাশ এবং সমাজের সাথে এগুলোর সম্পর্ক অধ্যায়ন করা। সামাজিক প্রয়োজনেই আইনের উদ্ভব এবং সামাজিক মূল্যবোধের উপর এই আইনের ভিত্তি। কাজেই আইন যে সকল সামাজিক প্রয়োজন মেটায় তা সকল সমাজের এক নয়। কাজেই এসকল প্রয়োজনের কোনো সমাধান আইন বিজ্ঞান দেয় না বটে, তবে এ সম্পর্কে আইনে তত্ত্ব বা নীতি সম্পর্কে আইন বিজ্ঞান নির্দেশ দেয়। আইন আইনগত ধ্যান-ধারণা সমূহ এবং সমাজ জীবনের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে আইন বিজ্ঞান।
দ্বিতীয়তঃ আইন বিজ্ঞান আইনগত ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। অন্যায় বা অবৈধ কার্য, আইনগত ক্ষতি, অভিপ্রায়, মোটিভ, অবহেলা, মালিকানা, দক্ষল ইত্যাদি আইনগত ধারণা বিভিন্ন আইন গ্রন্থে আলোচিত হয়। কিন্তু এগুলির উৎপত্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ চেষ্টা করা হয় আইন বিজ্ঞানে। ব্যাকরণ যেমন ভাষাকে শুদ্ধ ভাবে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে, আইন বিজ্ঞান আইনের মৌলিক ধারণা সমূহ বিশ্লেষণ করে আইনকে সহজতর করে। উদাহরণস্বরূপ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে যে তথ্য বিশ্লেষণ আইন বিজ্ঞান করে থাকে তার উপর ভিত্তি করে সমাজে আইন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এর সকল আইনগত ধারণাসমূহ পরিবর্তন হয় এবং এর উপর প্রভাব বিস্তারকারী সামাজিক উপাদান গুলি আইন বিজ্ঞানের আলোচিত হয়।
তৃতীয়তঃ আইনগত কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও কার্যকারিতা সম্পর্কেও আইন বিজ্ঞান অনুসন্ধান করে। আইন প্রণয়ন, বিধিবদ্ধকরন, বিচারের পূর্বে দৃষ্টান্ত অনুসরণ, বিচারকার্যে বস্তুনিষ্ঠ নীতি অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ও আইন বিজ্ঞান এর অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থঃ ন্যায় বিচার পরিচালনার জন্য এর মূল নীতিগুলিও আইন বিজ্ঞানে আলোচিত হয়। এছাড়া আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা করা এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করে আইন বিজ্ঞান।
পঞ্চমতঃ আইনের উৎস ও বিবর্তন ছাড়াও এর গবেষণামূলক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক বিশ্লেষন এবং নৈতিক বা দার্শনিক বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে আইন বিজ্ঞানের অন্যতম কাজ।
আইন বিজ্ঞানের এরূপ ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিধির কারণে সমাজ পরিচালনার কৌশলগত দিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৌশলী যেমন তার জ্ঞানকে প্রকৌশল শাস্ত্র বিভাগে ব্যবহার করে, তেমনি আইন বিজ্ঞান একটি নিয়মতান্ত্রিক বিজ্ঞান হিসেবে আইনের বিভিন্ন দিক বিকশিত করতে সাহায্য করে। যেহেতু মানুষের বাহ্যিক আচরণ কে নিয়ন্ত্রণ করে আইন সেহেতু অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান যথা সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি সকলের সাথে আইনবিজ্ঞানের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই আইনবিজ্ঞান যথার্থভাবে অধ্যায়ন করতে হলে এ সকল সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন । যেহেতু আইন মানুষের সর্বজনীন কল্যাণে নিবেদিত, সেহেতু আইন বিজ্ঞানের অধ্যায়ন অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর সামাজিক গণ্ডির মধ্যে অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে।
No comments