Breaking News

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা



Freedom of law

  বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কেবল নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণই যথেষ্ট নয়?

একটি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আইন পরিষদ ছাড়াও রাষ্ট্র চলতে পারে। কিন্তু বিচার ব্যবস্থা ছাড়া কোন সভ্য সমাজের কল্পনা করা যায় না। মনো বিজ্ঞানীদের মতে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারলে কারো পক্ষে তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব না। বিচার বিভাগের উপর এটা সমভাবে প্রযোজ্য। লর্ড ব্রাইসের মতেঃ বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতা উপর নির্ভর করে সরকারের উৎকর্ষতা। তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিচার বিভাগের উপর যে কোন প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিবন্ধকতা না সে তার ব্যবস্থা করা সরকারের প্রশাসনযন্ত্রেরই কাজ। এটা অনস্বীকার্য যে, গণতন্ত্রের জন্য আইনের শাসন এক অনিবার্য ও পূর্ব শর্ত। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার নিজে মামলা করছে এবং সরকারের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা হচ্ছে। বিচার বিভাগীয় কর্মকাণ্ডের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে শুনে এবং তাদের বক্তব্য যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা করে কারণ ও যুক্তি সহকারে আদালত একটা সিদ্ধান্ত দেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলোতে যেখানে সরকার একটা পক্ষ সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি শুধু প্রাসঙ্গিকই নয় জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয়। তাই দেশে আইনের শাসন তথা গণতন্ত্রের উত্তরণ ও সংরক্ষণের জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে কোন একক বিষয়ের উপর এই স্বাধীনতা নির্ভর করে না। 

যে সকল বিষয়ের উপর বিচারকদের স্বাধীনতা নির্ভর করে তা নিম্নরূপ ঃ

১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন ঃ আইন বিভাগ আইনের প্রণয়ন করে, বিচার বিভাগ সে আইনের ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করে এবং নির্বাহী বিভাগ শাসন কার্য পরিচালনা করে। প্রত্যেক বিভাগ তার স্ব স্ব  ক্ষেত্রে বিচরণ করবে। অন্য বিভাগে হস্তক্ষেপ করবে না বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে নাএরূপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকগণ চাকরিজীবী। চাকরী ক্ষেত্রে বেতন, পদোন্নতির, বদলি,  পেনশন ইত্যাদি অনেক দেশেই শাসন বিভাগের আওতাধীন।এ রুপ ক্ষেত্রে  শাসন বিভাগের কর্মকর্তা ব্যক্তিরা বিচারকদেরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই ক্ষমতা  পৃথকীকরণের মাধ্যমে বিচারকদেরকে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে।

২. বেতন-ভাতা ইত্যাদি ঃ বিচারকদের বেতন ও ভাতাদি জাতীয় বেতন স্কেল এর অন্তর্ভুক্ত না করে একটা স্বতন্ত্র আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। গেট বৃটেন ও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম অনুসরণ করা হলেও অধস্তন আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয় না। 

৩. নিরাপত্তা ঃ বিচারিক কার্যক্রমের জন্য বিচারকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তার কার্যের পরিণতির জন্য যেন তাকে শঙ্কাযুক্ত বা চিন্তিত না হতে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিচার কার্যক্রমে বিচারকের আচরন  থাকবে সম্পূর্ণরুপে আলোচনা-সমালোচনার উর্ধে।

৪. আদালত অবমাননার শাস্তি ঃ আদালতের নির্দেশনা বিনা বাক্যব্যয়ে যেন সকলে মেনে চলে, আদালত কে যেন কেউ অবজ্ঞা করতে না পারে তার জন্য যথোপযুক্ত আইন থাকতে হবে। অবজ্ঞা কারীকে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায় তার বিধি-বিধান থাকতে হবে। 

৫. জনগণের আস্থা ঃ বিচার বিভাগের উপর জনগণের যেন পূর্ণ আস্থা থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য আইনগত পেশার (যার মধ্যে আইন শিক্ষা ও আইন ব্যবসায়ী এবং বিচারক অন্তর্ভুক্ত) একটা সম্মানজনক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে হবে। উপযুক্তভাবে শিক্ষিত, মার্জিত ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। এজন্য আকর্ষণীয় বেতন ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে হবে। কোন বিচারিক কার্যক্রমে যেন বিচারকের সামান্যতম স্বার্থ না থাকে সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। অন্যথায় তা স্বাভাবিক বিচারের বিধির  পরিপন্থী হবে। আদালত অবমাননার শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারককে খুবই সতর্ক হতে হবে। বিচারপতি মুর্শিদের ভাষায় -
O, it is good to have a giant strength
but to use like a giant is tyranneous.
এভাবে একটি স্বচ্ছ,যোগ্য আস্থাশীল বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে পারলে বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।
অর্থাৎ শুধু নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করলেই যথেষ্ট হবে না। রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন ও ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। ক্ষমতা  স্বতন্ত্রীকরন নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারক পদে নিয়োগ, পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা প্রদান, নিরাপত্তা, আদালত অবমাননার শাস্তি, বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভরশীল।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শব্দটি  যেসব ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় ঃ 

বিচারকের কাজ হলো প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার কার্য সম্পন্ন করা। সম্পূর্ন নির্ভয়ে প্রভাব মুক্ত হয়ে জবাবদিহিতা না করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করার যদি পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় তবে বলা যায় যে বিচারকের মূল স্বাধীনতা রয়েছে। বিচারকার্যে বিচারকের ব্যক্তিগত উপাদান বর্তমান থাকতে পারে। তাই একজন বিচারকের বিচার কার্যে ভুল হতে পারে, তার মন্তব্যে অন্যের সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে, এমনকি তার কার্যাবলি বিদ্বেষমূলক হতে পারে। এজন্য প্রত্যেক সভ্য দেশে বিচারকদের নিরাপত্তার বিধান করা হয়। বিচারকের ভুল বা  মানহানিকর মন্তব্য কিংবা বিদ্বেষ মূলক আচরণ ইত্যাদির জন্য কোন ক্রমে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কিংবা দেওয়ানী মামলা করা যায় না। গ্রেট বৃটেনের পার্লামেন্টারী সার্বভৌমত্ব রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনবোধে কোন গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিচারকের আচরণ নিয়ে আলোচনা হয় না। এসকল অব্যাহতি বা নিরাপত্তাকে বিচারকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলে।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন কি নাঃ 

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে 22 অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়, " রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন। "এই মূলনীতির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মূল সংবিধানের 115 ও 116 অনুচ্ছেদে বিধান রাখা হয়ে। 115 অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ ক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিচারকার্যে জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজের নিয়োগের বিধান করা হয়। কিন্তু 1975 সালের চতুর্থ সংশোধনীর পর 115 অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধানসমুহ  অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করবেন।"
মূল সংবিধানের ১১৬ ধারায় বিচার কাজে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য ব্যক্তিদের কর্মস্থল নির্ধারণ বা বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলাবিধানের  দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল সুপ্রিম কোর্টের উপর। কিন্তু 1975 এর সংশোধনীর পর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় রাষ্ট্রপতির উপর। তবে এই সময় ১১৬ ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করা হয় যেখানে বলা হয়েছে যে, এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার কার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে।  এছাড়া সংবিধানের 94 (৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।
কাজেই বিচারকের স্বাধীনতা সম্পর্কে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা যথার্থ ও অর্থবহ করতে হলে ক্ষমতার পৃথকীকরণ প্রয়োজন। সেটা এখনো বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে অবর্তমান। বিচারকগণ ও ম্যাজিস্ট্রেটগণ এখনো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং তাদের পদোন্নতি, বদলি, পেনশন ইত্যাদি শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তবে বিচারকগণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। বিচার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকের কোন কাজের জন্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করা যাবে না এবং এতদসংক্রান্ত কাজের জন্য কোন বিচারকের আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এছাড়া আদালত অবমাননার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। 

মাজদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলা, 1999 ঃ 

মাজদার হোসেনসহ ৪৪১ জুডিশিয়াল অফিসার ১৯৯৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন করেন। আবেদনে অন্যান্য দাবিসমূহের মধ্যে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এর দাবি ছিল। সরকার পক্ষ এ মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নি। একতরফা শুনানি করে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৭ সালে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে। আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আংশিক পরিবর্তন করে ১৯৯৯ সালে রায় ঘোষণা করেন। এ রায়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য ১২ টি নির্দেশনাবলী দিয়েছে।
বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এর দাবি বৃটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এর জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে ফলপ্রসূ কিছুই হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট তা খুব গুরুত্বসহকারে বিষয়টি বিবেচনা করেন এবং এ জন্য কি কি করনীয় তা বর্ণনা দিয়ে সরকারকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ সরকার, বিএনপি নেতৃত্বে জোট সরকার, লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউই এগুলো বাস্তবায়ন করেনি। শেষে সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলে তড়িঘড়ি করে ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধনপূর্বক নিম্ন আদালত গুলোকে নির্বাহী বিভাগ হতে নভেম্বর, ২০০৭ সালে  বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও তারা এখন আর বিচারিক কার্যাবলি সম্পাদন করেন না।
মাজদার হোসেন মামলায় অন্তত এতটুকু অর্জন করা হয়েছে।

No comments